ছবি : প্রতীকী
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে চলমান বার্তা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কীয় বিষয়গুলির ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ থেকে শুরু হলো নতুন পর্ব “আমাদের প্রাত্যাহিক জীবন ইসলাম”। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব ।
পারিবারিক জীবন:
বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক পরিবারেই দেখা যায় পারিবারিক কলহ লেগেই আছে। সন্তান বাবার কথা শুনছে না, মেয়ে চলছে নিজের মত করে তথাকথিত আধুনিক ধাঁচে। অনেক সন্তানকে দেখা যায় নেশাগ্রস্ত হতে। এ সমস্যা বিত্তশালী থেকে শুরু করে নি¤œবিত্ত পর্যন্ত। সকল স্তরের বাসিন্দাদের মধ্যেই এ সমস্যা বিদ্যমান। মা-বাবার আদরের ধন নিজ সন্তানের এমন পরিণতি কোনভাবেই সহ্য করতে পারেন না। নিজেরা ভুল যখন স্বীকার করেন তখন আর সুপথে ফেরানোর সুযোগ থাকে না। অথচ শুধুমাত্র ইসলামী রীতিনীতি মেনে চললেই এমনটি হতো না।
ইসলাম কি বলে:
একটি শিশু সর্বদাই সে তার পিতা-মাতাকে অনুসরণ করে। এছাড়া বড় ভাই, বোন, একান্নবর্তী পরিবারের চাচা-ফুফু সবাইকে। তবে শিশুটি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় মা এবং বাবাকে। এক্ষেত্রে মা-বাবা যদি নিজ ঘরে বা বাসায় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলেন তাহলে ঐ শিশুটিও বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁদেরকে অনুসরণ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। যেমন: বাবা-মা যদি বাসায় নিয়মিত নামাজ পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন, নিজেদের আচার-আচরণ মার্জিত রাখেন, তাহলে জোর দিয়েই বলা যায় শিশুটি ইসলামী সংস্কৃতিতেই বড় হবে, নিজের মধ্যে ইসলামী অনুশাসন মানার তাগিদ অনুভব করবে ইনশাআল্লাহ। তাঁকে যে শিক্ষায়ই শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হোক না কেন, যে সন্তান নিজের চরিত্রে ইসলামী মূল্যবোধ লালন করতে শিখে এবং সে অনুযায়ী চলে সে সন্তান কখনো বিপথগামী হতে পারে না। তার দ্বারা পরিবার তথা সমাজের কোন অনিষ্ট হওয়ার এতটুকু সম্ভাবনাও থাকে না। আমাদের উচিৎ কোরআনের আলোকে এবং নবীজির পারিবারিক জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ী চলা। তবেই পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতিটি স্তরে শান্তির আবহ বিরাজ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ‘আর স্মরণ কর, যখন আমি বনি ইসরাইলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং সদাচারণ করবে পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতিম ও মিসকিনদের সাথে।’ (আল-বাকারা, ২:৮৩)।
‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপণীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।’ (বনি ইসরাইল, ১৭:২৩)।
পিতা-মাতার সাথে সদাচারণের ব্যাপারে কোরআন মাজিদে একাধিকবার ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার হকের পরেই পিতা-মাতার হক। তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করা মানেই আল্লাহ’র আদেশেরই আনুগত্য করা। আর তাঁদের অসম্মান করার অর্থই হলো আল্লাহ’র আদেশকেই অমান্য করা। আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ-নির্দেশ পালন না করার অর্থ হলো জাহান্নামের বাসিন্দা হওয়া।
হজরত আবু উমামা রা. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল স. সন্তানের উপর তাদের পিতা-মাতার কি অধিকার? তিনি উত্তর দিলেন, তারা তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ)।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. বলেন, তিনি রাসুল সা. কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোন আমল বা কাজ আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়? তিনি উত্তরে বলেন, সময়মত নামাজ আদায় করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরপরে কি? তিনি উত্তর করলেন, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অত:পর কি? তিনি উত্তর করলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারি, মুসলিম)।
হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞাসা করেন, কে আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার? রাসূলুল্লাহ স. উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, অত:পর কে? আর তিনি উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি চতুর্থবারের মত জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, তোমার পিতা। (বুখারি, মুসলিম)।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার রয়েছে নির্ধারিত দায়িত্ব। শিশু জন্মের পর পিতা-মাতার প্রথম কাজটি হলো সন্তানের আকিকা দেয়া, ইসলামী অর্থবহ একটি সুন্দর নাম রাখা, বয়োবৃদ্ধির সাথে তাকে ইসলাম শিক্ষা দেয়া, আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া, ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী সন্তানকে চলতে শেখানো ইত্যাদি। সন্তানকে ভালোবাসতে বলেছে ইসলাম। তবে সন্তানের প্রতি অন্ধ ভালবাসা ও তাদের অত্যধিক নিরাপত্তার বিষয়টির চিন্তা যাতে পিতা-মাতাকে আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফেল করে না দেয়। পিতা-মাতার এই দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কোরান মজিদে একাধিকবার সর্তক করা হয়েছে। কারণ সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেন যে, জাগতিক ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে আনন্দে বিভোর থেকেও আল্লাহ্্র প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যে আমরা গাফেল থাকি কিনা? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্্ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’ (মুনাফিকুন, ৬৩:৯)। ‘সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা। আর স্থায়ী সৎকাজ তোমার রবের নিকট প্রতিদানে উত্তম এবং প্রত্যাশাতেও উত্তম।’ (কাহফ, ১৮:৪৬)। ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান।’ (তাগাবুন, ৬৪:১৫)।
পিতা-মাতার সাথে ইহসানপূর্ণ আচরণ করার ব্যাপারে যেমনি ছেলে-মেয়েকে আদেশ দেয়া হয়েছে, তেমনি পিতা-মাতার প্রতিও ছেলে-মেয়ের ব্যাপারে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করা হয়েছে। ছেলে-মেয়েকে ভালবাসা ও তাদের যতœ নেওয়া মানব প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্যে কোরআন মাজিদে ছেলেমেয়ের সাথে আচরণ সংক্রান্ত কিছু মৌলিক নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে এবং বাকিগুলোকে পিতা-মাতার সুবিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করার জন্যে পিতা-মাতার প্রতি একটি সার্বজনীন নির্দেশনা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ অঙ্গীকারের আহবান। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে, ‘পিতামাতা তার সন্তানদেরকে সর্বোত্তম শিক্ষা-দীক্ষা প্রদান করবে, যা তাদেরকে একজন ভাল মুসলিম হিসেবে গড়ে ওঠতে সাহায্য করবে। যদি পিতা-মাতা তাদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়, তাদের সন্তান-সন্ততি বিপথগামী হতে পারে এবং ফলে আল্লাহর আযাব ও ক্রোধে নিক্ষিপ্ত হবে।’ আমর ইবনে শুআইব রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, “তোমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সাত বছর হলে নামাজের আদেশ প্রদান কর এবং তারা দশ বছর বয়সে উপণীত হলে এজন্য তাদেরকে প্রহার কর (যদি তারা নামাজ না পড়ে) এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও” (আবু দাউদ)।
পিতা-মাতাকে আদেশ দেয়া হয়েছে তাদের সন্তানদের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষা, নির্দেশনা, প্রশিক্ষণ, স্নেহ-মমতা, আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত করতে, যা তাদেরকে একটি ধার্মিক ও পূণ্যময় জীবন যাপনে সাহায্য করতে পারে। যদি পিতা-মাতার কিছু অসতর্কতার কারণে সন্তানরা বিপথে চালিত হয়, পরিবার কিংবা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে তবে তারা সন্তানদের অপরাধের জন্যে সমানভাবে দায়ি হবেন। পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ যদি ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে তবেই পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় বিচরণ করবে স্বর্গীয় সুন্দর।
(আগামী পর্বে থাকছে সামাজিক জীবনে ইসলাম)
আরও পড়ুন >>নবীর জীবন, আমাদের জন্য শিক্ষনীয় (১ম পর্ব)