১৮ দোলায় প্রিয় স্বাধীনতা
নূরুন্নাহার নীরু
১৮/০৮/১৮ ৷ বাংলাদেশের রাজধানী প্রিয় শহর ঢাকা আজ উন্মত্ত৷ চলছে আন্দোলন৷” নিরাপদ সড়ক চাই৷” এ শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ৷গতকাল কলেজ পড়ুয়া দু’জন ছাত্রছাত্রী একই সাথে বাসচাপা পড়ে নিহত হওয়াতে সমবয়সীরা কেউ আজ আর বিদ্যালয়ের শ্রেণিপাঠে নেই৷ নেমে পড়েছে সড়ক আইনের বাস্তবায়ন কার্যে৷ মায়েদের সহযোগিতাও চোখে পড়ার মতো।
কে ওদের নেতা? কার অঙ্গুলি নির্দেশে ওরা এতটা বলীয়ান? কিছুই জানা যায়নি৷ কিন্তু জানালা খুলে, ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথবা রাস্তায় বেড়িয়ে যা জানা গেল তা আমাকে ফিরিয়ে নিলো সূদূর ৭১৷ এমনি উত্তাল জনতা; এমনই আন্দোলন; এমনই আপোষহীন শ্লোগান৷ শিশু-যুবা-বৃদ্ধ-কিশোর কেউ বাদ ছিল না সে আন্দোলনের নিশান উড়াতে৷
৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে নাড়িয়ে দেয়৷ এক মুজিবুরের কণ্ঠ লক্ষ জনতার কণ্ঠ হয়ে যায়৷ ২ মার্চ হতেই একটা অস্থিরতা অনুভব করছিল জাতি৷ তারই দিক নির্দেশনা পেলো ০৭ মার্চে৷” ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ো৷”
ঠিক তাই৷ ছাত্রীনেত্রী মেঝ’পাদের গ্রুপটা দেখতাম প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিল, মিটিং কাউন্সিলিং এ ব্যস্ত৷ যখন যেখানে সুযোগ ঘটতো এমনকি আমাদের বাসা ও বাদ পড়েনি এথেকে৷ আম্মার চোখে-কর্মেও ক্লান্তি দেখিনি কখনো৷ সোৎসাহে বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের রান্নাখাওয়ার ব্যবস্থথা করেছেন নিরলসচিত্তে৷ মাঝে মাঝে বড় বড় নেতারাও আসতেন৷ চলতো রাত জেগে দিক নির্দেশনা আরোছিল আপাদের কলেজের ভি.পি. চপল আপার তেজোদ্বীপ্ত বক্তব্য, জি.এস রুশো আপার মুষ্টিবদ্ধ জাগরণী শ্লোগান- সে কি উদ্দামতা!
আমি শুধু অবাক হয়ে দেখতাম আর মনের কল্পনায় গড়ে ফেলতাম বেড়িকেডের কত্ত উপায়৷ হ্যাঁ বেড়িকেড দিতে হবে পাকিদেরকেে৷ মহকুমা শহরের নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় বড়ভাই বোরহান ও বসে নেই! সে তাঁর গ্রুপ নিয়ে প্রতিদিন পাড়ায় পাড়ায় টহল দেয়ার দায়িত্বটি চালিয়ে যাচ্ছে৷ আমিই আর বসে থাকি কেন! পাড়ার ছেলেমেয়েরা সবসময়ই আমার দাপটের কাছে হার মেনে এসেছে৷ এবারও তথৈবচ৷ সবাই আমরা মরিচের গুড়োর প্যাকেট নিয়ে প্রস্তুত৷ পাকআর্মি কাছে এলেই ছিটিয়ে দেব৷ এমন উত্তেজনা নিয়ে কি আর ঘরে থাকা যায়? রাস্তাই আমাদের আস্তানা৷
আজকের শিশুরাও রাজপথে৷ বলা যায় ওরা গড় বয়সে ১৮৷ আজ ২০১৮ সালে এসে এই ১৮ বয়সীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গাড়ীর গতি নিয়ন্ত্রন করছে, পরিবর্তন করছে ভুলপার্শ্বে চলার নিয়ম, দেখছে সঠিক কাগজপত্র, বাধ্য করছে যানবাহনকে সারিবদ্ধভাবে চলার ৷এখানে কেউ ছাড় পাচ্ছে না! সে যে ই হোক কি মন্ত্রী কি মিস্ত্রী!~~কিন্তু কেন? এরাতো ভিনদেশী নয়? এরাতো পাক বাহিনী নয়? তবু কেনো ওদের সাথেই লড়তে হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে জাতি দু’শ্রেনীতে বিভক্ত !শাসক শোষকের প্রশ্নটা নতুনভাবে জাগে কেন? কেন আজ ২০১৮ তে এসে ১৮ এর শিশুরা আন্দোলনরত?
রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খান সংলাপের নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারল্যতাকে ঠকিয়ে এক বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় নীরিহ বাঙালীর উপর৷ কিন্তু পেরেছে কি? হটতে হলো ওদেরকেই৷ অন্যায় কখনো জিততে পারে না৷ দীর্ঘ নয় মাস পরে হলেও হানাদাররা মাথানত করতে বাধ্য হলো৷ সে যুদ্ধ ছিল দু’টি ভিন্নভাষাভাষি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে৷ সে সময় পূর্বপাকিস্তানের আন্দোলনরত বাঙালীর জন্য সবচেয়ে ভরসার স্থলছিল পূর্ববাংলার পুলিশ বাহিনী৷ তাদের সক্রিয় অংশগ্রহনেই একসময় ফিরে পেলো জাতি কাঙ্খিত স্বাধীনতা৷ কিন্তু আজ? এ কার বিরুদ্ধে আন্দোলন? দেশের প্রধান রক্ষক নির্ভরতার স্থল এই পুলিশ বাহিনী এত অচেনা কেন? কেন হঠাৎ আক্রমন? ওরাতো একটু বুঝিয়ে আশ্বাস দিয়েই শিশুগুলোকে রাজপথ মুক্ত করতে পারতো? ওরা তো স্বাধীন বাংলার আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সন্তান! তবু কেন বেধড়ক মারপিট ওই কচি প্রাণগুলোর উপর? ছত্রভঙ্গ করতে, জীবনে আর কোনোদিন আন্দোলনের নামে রাজপথ না মাড়াানোর যেনো কত ফন্দি, কত কসরত! ওরাতো ৭১ দেখেনি! তবু কি আজো ওরা ৭১ এর রক্তই বহন করছে? তবে কি ১৮ ই দুলিয়ে দিলো ৭১ এর ক্ষয়িষ্ণু প্রৌঢ়ত্বকে!
প্রশ্ন আর প্রশ্ন! প্রশ্নের টাইফুন মাথায় নিয়ে হাঁটছিল সুমনা ৷ চোখের সামনে ভেসে উঠছে পাকিদের চিত্র৷ কিন্তু সুমনা লুটিয়ে পড়লো রাজপথে৷ কোথা থেকে এলোপাতাড়ি বুলেটে ঝাঁঝড়া করে দিল ওর পিঠ৷ ভীতসন্ত্রস্ত কচি কচি কিশোর কিশোরীরা আর্তচিৎকারে হরিণের মতদ্বিগবিদিক ছুটছিলো ৷কানের পর্দা ফাটানো চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো ৭১ এর আর্মি ক্যাম্প থেকে ভেসে আসার মত৷ আহা, ওরা না হয় একটা দাবী ই করেছিলো! কত অন্যায়ের প্রতিবাদকারী এক সময়ের নেত্রী সুমনা আজ বয়সের ভারে বন্ধ্যা প্রৌঢ়ত্বে নিমজ্জিত৷ সুমনার জীবন প্রদীপ নিভতে নিভতে ভেসে উঠলো হৃদয়ে ৭১ এর শেষ দৃশ্য৷
কিভাবে ভাইজান যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হলেন, মেঝ’পা কিভাবে সদলবলে আর্মি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাঁচলেন, মামা কিভাবে ঘরছাড়া হয়ে যুদ্ধের পথে নিখোঁজ হলেন৷— তবুও উড়েছে লালসূর্য বুকে নিয়ে সবুজ পতাকা৷ কোথায় গেলো সে স্বাধীনতা৷ একটা পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পরও যে প্রশান্তি ছিলো ওদের আজকের শিশুরা পাবে কি তার এতটুকু ত্যাগের স্বীকৃতি! পরের দিন খবরের কাগজে মৃত সুমনার ছবিসহ আন্দোলন ছত্রভঙ্গের কোনো চিত্রই এলো না শুধু একবুক অনুভূতি ছড়িয়ে গেলো বাংলার আকাশে বাতাসে ১৮ দুলিয়েছে প্রিয় স্বাধীনতা৷
আরও পড়ুন: জীবনের গল্প